হস্তাক্ষর, স্বাক্ষর এবং আঙুলের ছাপ বিশ্লেষণ
/ ফরেনসিক ডকুমেন্টস পরীক্ষা
হস্তাক্ষর,
স্বাক্ষর এবং আঙুলের ছাপ বিশ্লেষণ হল ফরেনসিক বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা নথিপত্রের
সত্যতা যাচাই, জালিয়াতি শনাক্তকরণ এবং অপরাধ তদন্তের জন্য ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশে
সরকারি ও বেসরকারিভাবে এই সেবাগুলো প্রদান করা হয়, যা বিচারিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রমে
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
হস্তাক্ষর,
স্বাক্ষর এবং আঙুলের ছাপ বিশ্লেষণের মূলনীতিঃ
এই
বিশ্লেষণ মূলত তিনটি প্রধান ধাপে সম্পন্ন করা হয়:
১.
নমুনা সংগ্রহ ও পর্যবেক্ষণ:
সন্দেহজনক বা বিতর্কিত নমুনা এবং রেফারেন্স বা সত্যিকার নমুনা সংগ্রহ করা হয়।
এরপর নমুনা কাগজগুলোর
লেখার বিশ্লেষণ
করা হয়।
২. তুলনামূলক
বিশ্লেষণ: দুই
বা ততোধিক নমুনার মধ্যে মিল বা অমিল পরীক্ষা করা হয়। গ্রাফোলজি, জ্যামিতিক
বিশ্লেষণ, কালি পরীক্ষার মতো পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
৩. বিশেষজ্ঞ
মতামত প্রদান: রিপোর্ট বা প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়, যা আদালতে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার
করা যেতে পারে।
এভাবে তিনটি ধাপে ফরেনসিক পরীক্ষার মাধ্যমে স্বাক্ষর
বা হস্তাক্ষরের সত্যতা প্রমাণ করা হয়।
হস্তাক্ষর
বিশ্লেষণ কিভাবে করা হয়?
হস্তাক্ষর
বিশ্লেষণ বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে সম্পন্ন হয়, যেখানে লেখার ধরন ও গঠনের উপর গুরুত্ব
দেওয়া হয়। এটি গ্রাফোলজি বা হ্যান্ডরাইটিং এনালাইসিস নামে পরিচিত।
মূল
পর্যায়সমূহ:
১.
চাক্ষুষ বিশ্লেষণ (Visual Analysis)
লেখার
ধরন, আকার,
স্পেস,
লেখার চাপ, কালি ছড়ানোর ধরন ইত্যাদি পরীক্ষা
করা হয়।
২.
তুলনামূলক বিশ্লেষণ (Comparative Analysis)
সন্দেহজনক
নমুনা ও রেফারেন্স নমুনার মধ্যে পার্থক্য খুঁজে বের করা
হয়। স্বাক্ষরের গতি, রৈখিকতা, বাঁক, সংযোগের ধরন ইত্যাদি পরীক্ষা করা হয়।
৩.
টেক্সচার ও কালি বিশ্লেষণ (Ink & Paper Analysis)
কাগজের
গঠন, কালির রাসায়নিক গঠন এবং লেখার গভীরতা পর্যালোচনা করা হয়। তাছাড়া
প্রয়োজনে আল্ট্রাভায়োলেট
(UV) আলো, ইনফ্রারেড (IR) আলো এবং মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করা হয়।
স্বাক্ষর
বিশ্লেষণঃ
স্বাক্ষর
বিশ্লেষণের মূল ধাপসমূহ-
১. লেখার
গতি ও চাপ পর্যালোচনা:
লেখার
সময় কাগজের উপর চাপের ধরন বিশ্লেষণ করা হয়।
স্বাক্ষরটি দ্রুত নাকি
ধীরে কোনভাবে
করা হয়েছে তা
শনাক্ত করা
হয়।
২. স্ট্রোকের
ধরন পরীক্ষা:
স্বাক্ষরের
আকার, বাঁক এবং সংযোগ বিশ্লেষণ করা হয়।
হাতের
স্থিতিশীলতা ও গতির সূক্ষ্ম পরিবর্তন লক্ষ্য করা হয়।
৩. প্রযুক্তিগত
পরীক্ষা:
বিভিন্ন এনালাইটিকাল টুলস ও ডিজিটাল সফটওয়্যার এর মাধ্যমে
বিশেষজ্ঞ পরীক্ষকরা স্বাক্ষর বিশ্লেষণ করেন।
পরিশেষে, একটি আদালতে
গ্রহণযোগ্য
প্রতিবেদন তৈরি করা হয়।
আঙুলের
ছাপ বিশ্লেষণ কিভাবে করা হয়?
১.
আঙুলের ছাপের ধরন:
আঙুলের
ছাপ সাধারণত তিন প্রকারের হয়।
যথা-
আর্চ
(Arch): ঢেউয়ের মতো গঠন থাকে।
লুপ
(Loop): সর্পিল আকৃতির ছাপ।
হোর্ল
(Whorl): চক্রাকার নকশা।
২.
ছাপ সংগ্রহ পদ্ধতি:
ডাস্টিং
মেথড: ধুলার গুঁড়ো ব্যবহার করে লুকানো ছাপ তোলা হয়।
কেমিক্যাল
মেথড: বিশেষ রাসায়নিক ব্যবহার করে ছাপ দৃশ্যমান করা হয়।
ডিজিটাল
স্ক্যানিং: উচ্চ-রেজোলিউশনের ছবি নেওয়া হয়।
৩.
তুলনামূলক বিশ্লেষণ:
বিশেষ
সফটওয়্যার ও AI ব্যবহার করে সন্দেহজনক ফিংগারপ্রিন্ট ও রেফারেন্স ফিংগারপ্রিন্ট এর ছাপের মিল বিশ্লেষণ করা হয়।
এছাড়া বিশেষজ্ঞরা আঙ্গুলের ছাপের মিনুটিয়া পয়েন্টস (Minutiae Points) ও স্পেসিফিক বৈশিষ্ট্যগুলো পরীক্ষা করেন।
বাংলাদেশে
এই সেবা কোথায় পাওয়া যায়?
বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি দুই ধরনের প্রতিষ্ঠানে এ সার্ভিসগুলো
পাওয়া গিয়ে থাকে।
সরকারি
প্রতিষ্ঠান:
সিআইডি
ফরেনসিক ল্যাব (CID Forensic Lab):
বাংলাদেশের
অন্যতম প্রধান ফরেনসিক বিশ্লেষণ কেন্দ্র। কোর্ট প্রদত্ত স্বাক্ষর, আঙুলের ছাপ ও
নথি বিশ্লেষণ এখানে করা হয়ে থাকে। এটি
ঢাকার মালিবাগে অবস্থিত।
ঠিকানাঃ
সিআইডি হেডকোয়ার্টারস, মালিবাগ,
ঢাকা ১২১৭।
ফোন- +8801320019998.
ইমেইল-
addligcid@police.gov.bd
উল্লেখ্য,
CID থেকে কোর্ট অনুমতি ছাড়া কোনো ডকুমেন্ট এর স্বাক্ষর বা ফিংগারপ্রিন্ট তারা পরীক্ষার
জন্য নিয়ে থাকেন না।
বেসরকারি
প্রতিষ্ঠান:
বাংলাদেশের
একমাত্র বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ফরেনসিক সেবাভিত্তিক কোম্পানি বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অফ
ফরেনসিক সাইকোলজি এন্ড সাইন্সেস (Bangladesh Institute of Forensic Psychology
& Sciences – BIFPS Consultancy Ltd.) এই সেবা প্রদান করে থাকে।
যেকোনো সাধারণ ব্যক্তি, কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিগতভাবে এখানে তাদের ডকুমেন্টস
এর সিগনেচার ও ফিংগারপ্রিন্ট পরীক্ষা করাতে পারবেন। এনালাইসিস
শেষে ক্লায়েন্টকে বাংলাদেশ সরকারের Controller of Certifying
Authority (CCA) কর্তৃক সাইনকৃত রিপোর্ট প্রদান করে থাকে এ প্রতিষ্ঠান।
তাছাড়া BIFPS এর প্রতিটি রিপোর্ট বা সার্টিফিকেটে একটি
QR code থাকে। উক্ত QR code স্ক্যান করলে গভঃমেন্টের সার্ভারে BIFPS এর রিপোর্ট
ও সার্টিফিকেটগুলো দেখা যায়।
ঠিকানাঃ ১/৮৫/সি, ইস্টার্ন বনবীথি শপিং কমপ্লেক্স (দশ তলা
মার্কেট), দক্ষিণ বনশ্রী প্রজেক্ট রোড, ঢাকা
১২১৭।
ফোন/হোয়াটসঅ্যাপ: +8801988896656
ইমেইলঃ forensicbd.org@gmail.com
ওয়েবসাইটঃ www.forensicbd.org
বাংলাদেশে
ফরেনসিক ডকুমেন্টস পরীক্ষার রিপোর্ট গ্রহণযোগ্যতা নিরীক্ষে ব্যবহৃত এ সংক্রান্ত আইনসমূহঃ
১.
সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২ (Evidence Act, 1872)
সাক্ষ্য
আইনের ৪৫ নং ধারায়, আদালতে বিশেষজ্ঞ মতামত হিসেবে তৃতীয় ব্যক্তির মতামত হস্তাক্ষর, স্বাক্ষর
ও আঙুলের ছাপের ফরেনসিক প্রমাণ প্রাসঙ্গিক হিসেবে বিবেচিত হবে।
২.
ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ (Criminal Procedure Code, 1898)
অপরাধ
তদন্তের ক্ষেত্রে ফরেনসিক বিশ্লেষণের নিয়মাবলি, অভিযুক্তের
অধিকার, বিচার, শাস্তি ও আপিলসহ বিভিন্ন বিষয়ে নির্দেশনা দেয় এ আইন।
৩. সাক্ষ্য আইন – এর অন্যান্য
কিছু ধারাসমূহঃ
- ৪৫ নং ধারা অনুযায়ী, বিশেষজ্ঞের
মতামত প্রমাণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য। হ্যান্ডরাইটিং ও ফিংগারপ্রিন্ট বিশ্লেষণ বিশেষজ্ঞ মতামতের আওতাভুক্ত।
- ৪৭ নং ধারা অনুযায়ী, হস্তলিপি
সম্পর্কে অভিজ্ঞ এমন ব্যক্তিদের অভিমত দ্বারা বিতর্কিত হস্তলিপি প্রমাণ করা যায়।
বিদেশী আইন, চারুকলা, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে আদালতকে যখন সিদ্ধান্তে আসতে হয় তখন এই
সকল বিষয়ে অভিজ্ঞ বা পারদর্শী ব্যক্তিদের অভিমত আদালতে প্রাসঙ্গিক হয়।
- ধারা ৭৩ অনুযায়ী, স্বীকৃত বা প্রমাণিত
স্বাক্ষর দ্বারা বিতর্কিত হস্তলিপি প্রমাণ করা যায়।
কোন কোন ক্ষেত্রে আপনি এই সার্ভিস নিতে পারবেন?
১. কেস শুরুর পূর্বে: আদালতে
কেস শুরুর পূর্বেই একজন ব্যক্তি ব্যক্তিগত উদ্যোগে জেনে নিতে পারেন যে তার দলিল বা
ডকুমেন্ট এ উল্লেখিত স্বাক্ষর ও ফিংগারপ্রিন্টটি আসল অথবা জাল কি না। এবং রিপোর্ট
অনুযায়ী নিশ্চিত হয়েই সে আইনি মামলার জন্য আগাতে পারেন।
২. নিশ্চিত হওয়ার জন্য: কোনো
আইনজীবী তার ক্লায়েন্টের কেসটি গ্রহণ করবেন কি না বা ক্লায়েন্ট কর্তৃক প্রদত্ত ডকুমেন্টটি
কতটুকু গ্রহণযোগ্য তা যাচাই করে নিতে এ সার্ভিস গ্রহণ করতে পারেন।
৩. অল্প সময়ের মধ্যে রিপোর্ট প্রাপ্যতা: সিআইডি
তে রিপোর্ট পেতে কয়েক মাস সময় লেগে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে
ক্লায়েন্ট বা তার আইনজীবী অল্প সময়ের মধ্যে (মাত্র
৩ থেকে ৫ দিন) রিপোর্ট পেতে চাইলে বা সিদ্ধান্ত নিতে চাইলে
BIFPS Consultancy থেকে এ সার্ভিস নিয়ে থাকেন।
৪. রিপোর্ট ভ্যারিফিকেশনের জন্য: সিআইডি
প্রদত্ত রিপোর্ট এর ফলাফলে কোনো ক্লায়েন্ট বা তার আইনজীবী কর্তৃক অসন্তুষ্টি দেখা দিলে,
সে দ্বিতীয় ভ্যারিফিকেশনের জন্য BIFPS Consultancy তে যোগাযোগ
করতে পারেন। সেক্ষেত্রে, রিপোর্ট সেম আসলে
ক্লায়েন্ট নিশ্চিত হবেন এবং রায়টি স্বাচ্ছন্দ্যে গ্রহণ করবেন।
আর রিপোর্ট ভিন্ন আসলে কোর্ট সাধারণত দু পক্ষের রিপোর্ট নিয়ে থাকে এবং উভয়পক্ষ
থেকে দুজন এক্সপার্টকে উক্ত রিপোর্ট সম্বলিত বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসা করে থাকে। এবং স্বচ্ছতা
পাওয়ার জন্য প্রয়োজনে এটি থার্ড ভ্যারিফিকেশনের জন্য পাঠায়।
৫. প্রমাণের পাল্লা ভারী করার জন্য: একটি
কেস লড়তে এবং তা থেকে সুষ্ঠু বিচার লাভের জন্য যথেষ্ট সাক্ষী ও প্রমাণাদির প্রয়োজন
হয়ে থাকে। তাই কোনো ক্লায়েন্ট ন্যায়বিচার পাওয়ার লক্ষ্যে নিজেদের প্রমাণের
পাল্লা ভারী করতে ফরেনসিক এক্সপার্ট কর্তৃক প্রদত্ত রিপোর্ট যাচাইয়ের জন্য পাঠাতে পারেন।
৬. অন্য যেকোনো কারণে: উপরোক্ত
কারণগুলো ছাড়াও অন্য যেকোনো কারণেই একজন ব্যক্তি বেসরকারিভাবে তার দলিল,
স্টাম্প, নোটবুক বা অন্য যেকোনো কাগজের উপর লিখিত হ্যান্ডরাইটিং,
সিগনেচার অথবা ফিংগারপ্রিন্ট পরীক্ষা করে রিপোর্ট সংগ্রহ করতে পারেন।
সার্ভিস
গ্রহণের প্রক্রিয়া:
১.
আবেদন:
সংশ্লিষ্ট
প্রতিষ্ঠান বা ফরেনসিক বিশেষজ্ঞের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন করতে হবে।
২.
নমুনা প্রদান:
পরীক্ষার
জন্য সন্দেহজনক স্বাক্ষর বা আঙ্গুলের ছাপ এবং এক বা একাধিক রেফারেন্স স্বাক্ষর বা আঙুলের ছাপ জমা দিতে হয়।
৩.
পরীক্ষা ও বিশ্লেষণ:
বিশেষজ্ঞরা
নমুনা পরীক্ষা করেন এবং লেখার ধরন, বিভিন্ন ক্রাইটেরিয়া
ও স্পেসিফিক বৈশিষ্ট্যগুলো পর্যালোচনা করে ফলাফল
প্রদান করেন।
ফরেনসিক
বিশেষজ্ঞ কর্তৃক প্রদত্ত এই প্রতিবেদন প্রমাণ হিসেবে আদালতে ব্যবহার করা হয়। উল্লেখ্য
যে, Bangladesh Institute of Forensic Psychology &
Sciences (BIFPS) এর এক্সপার্টরা প্রয়োজনে আদালতে ভিজিট করে তাদের বিশেষজ্ঞ মতামত
কোর্টে প্রদান করে থাকেন।
পরিশেষে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ফরেনসিক নথিপত্র বিশ্লেষণ
জালিয়াতি শনাক্তকরণ, অপরাধ তদন্ত ও আইনগত সত্যতা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
পালন করে। বাংলাদেশে সরকারি ছাড়াও
বেসরকারিভাবে
এই সেবা এখন খুব সহজে
যাচ্ছে বিধায়, এটি অনেকের মাঝেই সাড়া ফেলেছে এবং বেসরকারিভাবে প্রাতিষ্ঠানিক
এ কার্যক্রম দেশের ফরেনসিক সেবা প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের পাশাপাশি আদালতের কার্যক্রমে সহায়ক ভূমিকা পালন
করবে তা নিশ্চিতই।